অনুসরণকারী

রবিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৭

পুলিশ মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধে প্রথম বুলেট ছুড়েছিল !





মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রথম বুলেট ছুড়েছিল পুলিশ। ২৫ মার্চের রাত সাড়ে ১১টায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গাড়ি বহর পুলিশ লাইন্সে হামলা চালানোর জন্য শান্তিনগর মোড়ে পৌঁছানো মাত্রই পাশের ডন স্কুলের (বর্তমানে ইস্টার্ন শপিং মল) ছাদ  থেকে ওই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন সৈনিককে লক্ষ্য করে প্রথম বুলেটটি ছোড়েন এজন বাঙালি পুলিশ সদস্য। থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে ছোড়া লক্ষ্যভেদী ওই বুলেটে পাকিস্তানি ওই সৈনিক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আর এতেই হানাদার বাহিনী বুঝতে পারে বাঙালিরাও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত হয়ে আছে। ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতে সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যারা মরণপণ লড়াই করেছেন, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

‘শহীদ পুলিশের রক্তের ঋণ’ বইতে এআইজি আবিদা সুলতানা উল্লেখ করেছেন, ‘অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের সদস্যরা পাক বাহিনীর আক্রমণের শিকার হতে পারেন, এমনই একটি ধারণা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আলোচিত হতে থাকে। শহরের বিভিন্নস্থানে কর্মরত পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের কাছ থেকেও একই ধরনের সংবাদ আসতে থাকে। ব্যারাকে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবিলায় প্রতিরোধযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সন্ধার পর পুলিশ কর্মকর্তারা খবর পান, যেকোনও সময় রাজারবাগসহ বিভিন্নস্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ চালাতে পারে। রাত ১০ টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে টহলরত একটি পুলিশ টহল টিম বেতার মারফত জানায়, পাকবাহিনীর একটি বড় ফোর্স যুদ্ধসাজে শহরের দিকে এগুচ্ছে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে খবর আসে, তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান ও বর্তমানে রমনা পার্কের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সাঁজোয়া যান অপেক্ষা করছে। এসব খবর পেয়ে রাজারবাগের বাঙালি পুলিশ সদস্যরা যে যার মতো প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
ওইদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের অস্ত্রাগারে কর্মরত পুলিশের স্পেশাল আর্মড ফোর্সের (এসএএফ) কনস্টেবল আবু সামা  বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা হামলা চালাবে এমন খবর আমরা জানতাম। আর ওইদিন সন্ধ্যায় যখন নিশ্চিত হলাম যে তারা হামলা চালাবেই, তখন আমাদের অনেক কর্মকর্তাই পালিয়ে যান। অস্ত্রাগারের ইনচার্জ সুবেদার আবুল হাশেম সন্ধ্যার পরপর অস্ত্রাগারে তালা দিয়ে আরআই মফিজ উদ্দিনের কাছে চাবি দিয়ে চলে যান। সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে একটি ওয়্যারলেস ম্যাসেজ আসে যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢাকার দিকে আসছে। তখন দ্রুত আরআই মফিজ উদ্দিনের কাছে গিয়ে তিনিও পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার কাছে অস্ত্রাগারের চাবি চাইলে তিনি দিতে অস্বীকার করেন। পরে অনেকটা জোর করে তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে একটি অস্ত্রগারের তালা খোলা হয়। অন্য  অস্ত্রাগারের তালা শাবল দিয়ে ভেঙে ফেলি। পরে সেখান থেকে যে যার মতো থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও বেটা গান এবং গুলি নিয়ে যান বাঙালি পুলিশ সদস্যরা।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগের ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে অন্যান্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছিলেন কনস্টেবল বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়া। পরে তিনি সাব ইনস্পেক্টর হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে অবসরে যান। যিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সসহ রাজধানী ঢাকা আক্রান্ত হওয়া এবং বাঙালি পুলিশ সদস্যদের প্রতিরোধের বার্তা বেতার মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এজন্য শাহজাহান মিয়া পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে চরম নির্যাতনও ভোগ করেন। পরে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন এলাকায় বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন তিনি।
শাহজাহান মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ রাজধানীর বিভিন্নস্থানে হামলা চালায়, তখন আমি দায়িত্ব পালন করছিলাম। পাকিস্তানি বাহিনী যখন হামলা চালায় তখন রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টা। হামলা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি পুলিশ সদস্যরাও পাল্টা আক্রমণ করে। কাল বিলম্ব না করে আমি পূর্ব পাকিস্তানের সব বিভাগ ও জেলা শহরের পুলিশ স্টেশনগুলোতে একটি মেসেজ পাঠিয়ে দেই। সেই মেসেজটা ছিল—‘ওভার-বেইজ ফর অল স্টেশন্স অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিসেন অ্যান্ড ওয়াচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেল্ফস, ওভার।’ এ জন্য পরদিন ২৬ মার্চ ভোর পাঁচটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী আমাকে আটক করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন।’’ তিনি বলেন, ‘রাত ১২টার দিকে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের মরণপণ প্রতিরোধে থমকে যায় ট্যাংক ও কামান সজ্জিত পাকবাহিনী। একটু পরই মর্টার ও হেভি মেশিনগান দিয়ে গুলি বর্ষণ শুরু করে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের ৪টি ব্যারাকে আগুন লেগে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় আট শ’ সদস্য ট্যাংকবহরসহ প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রবেশ করে। এ সময় তাদের হাতে অনেক বাঙালি পুলিশ সদস্য হতাহত হন। আটক হন আরও ১৫০ জন পুলিশ সদস্য। পরে পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করে গেরিলা পদ্ধতিতে পাকবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। কেউ কেউ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ মালিবাগ, চামেলীবাগ প্রান্ত দিয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে।’
একইসময়ে রাজারবাগে অবস্থান করছিলেন পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল আলী। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের পূর্ব মুহূর্তে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। তখন তিনি রাজারবাগের পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের সতর্ক করেছিলেন। এই পাগলা ঘণ্টার শব্দ শুনেই সালামি গার্ডে জড়ো হন বাঙালি পুলিশ সদস্যরা।  
মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান নিয়ে লেখা ‘শহীদ পুলিশের রক্তের ঋণ’ বইয়ের মুখবন্ধে এআইজি আবিদা সুলতানা উল্লেখ করেন, ‘২৫ মার্চ কালরাতে রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরা প্রথম থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে প্রতিরোধ শুরু করেন। পুলিশের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের খবর ছড়িয়ে দেওয়ার পর প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন সারাদেশের পুলিশ সদস্যরা। একজন ডিআইজি ও চারজন পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন পদবির এক হাজার একশ’র বেশি পুলিশ সদস্য শহীদ হন মহান মুক্তিযুদ্ধে। আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন আরও অনেকে। প্রায় ১৪ হাজার পুলিশ সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

কবির শেখ

নেত্রকোণা জেলা পুলিশ




কোন মন্তব্য নেই:

কিশোরগঞ্জের সাহেব আলী পাঠান

  সাহেব আলী পাঠান (পুলিশ সুপার) জনাব সাহেব আলী পাঠান ১৯৮২ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়াচর উপজেলার পশ্চিম আবদুল্লাপুর গ্রামের এক সম...