পুলিশের ইহকাল পরকাল
সিলেটভিউ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২০১৬-১২-০২ ১১:২৭:২৩
:: আনসার উদ্দিন খান পাঠান ::
মরহুম সুরত আলী একজন ছোটখাটো পুলিশ অফিসার ছিলেন। হার্টের ব্যামোতে তিনি হঠাৎ পরলোক গমন করেন। পরলোক যাওয়ার আগে অবশ্য তাঁর চাকরি থেকে রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেই সুযোগে তিনি চশমার পুরু কাচের ভিতর দিয়ে পুলিশ নয় একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে নিজ সংসার, সমাজ আর দেশকে দেখে গেছেন ক'দিন। গিন্নির উচ্চস্বরে সাংসারিক অনটন সংক্রান্ত নিত্যদিনের তিক্ত বক্তৃতা, মাঝারী ও ছোট পুত্রের উচ্ছন্নে যাওয়া, তিন নম্বর কন্যার প্রেম করে অর্ধ বেকারের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া এবং তদউদ্ভুত ঘোলাটে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। রাস্তায় বিষাক্ত বাতাস সেবন, রাজনৈতিক ডামাডোল আর আইন-শৃখলার অবনতি সংক্রান্ত টেনশন ইত্যাদি সবমিলে তার দুর্বল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াকে দ্রুত নিস্তব্ধ করে দিল।
মরে যাওয়ার ৪০ দিন পর বিশেষ দোয়া উপলক্ষে মরহুমের সকল পুত্র কন্যা একত্রিত হলো। দোয়া আরজ গোজার শেষে রাত্রিবেলায় তার পুত্র-কন্যারা মনিমাণিক্যের সুরত আলীর জীবন ভর আঁকড়ে রাখা ফুল আঁকা মরচে ধরা ট্রাংকের ডালা ভাঙলো। মূল্যবান কিছু না পেয়ে শোকের মাত্রা আরো বাড়লো। পাওয়া গেলো রুমাল দিয়ে পেচানো একটা পুটলা তার মধ্যে একটা কিছু অদ্ভুত চিঠি, সুরত আলীর লেখা।
তার মধ্যে একটি এরকম-
"আশা করি আপনারা আমাকে চিনতে পেড়েছেন। দুষ্টের দমনকারী, শিষ্টের লালনকারী, অত্যাচারিতের ভরসা, আইনের রক্ষক, নিরাপত্তার প্রতীক কিংবা ঘোষখোর, চোরের বন্ধু, আইনের ভক্ষক, সরকারের পেটুয়া বাহিনী, জুলুমবাজ ইত্যাদি যেকোন গোত্রে আমাকে ফেলতে পারেন। যেটিতেই ফেলেন না কেন যুক্তির কোন অভাব হবে না। একই পোশাক, একই কাজ, একই সমতলে যুগ যুগ ধরে আছি। আমাকে চিনতে আপনাদের একটুও ক্লেশ হওয়ার কথা নয়। পক্ষান্তরে আপনাদের আমি ভাল করে চিনতে পারি না। আপনারা সকলেই উত্তম পোশাকে থাকেন, সুন্দর যুক্তিগ্রাহ কথা বলেন। গাড়ি, বাস, স্কুটার আর রিকসা দিয়ে প্রতিদিন নগরের রাস্তা ধরে পিপড়ের মত ছুটে যান। আমি চিনতে পারিনা আপনাদের মধ্যে কে রাষ্ট্রের কর ফাঁকি দিচ্ছেন, রাষ্ট্রের কোষাগারকে নিজের স্বপ্নে পাওয়া ধন বলে নয়-ছয় করছেন, পয়সা দিয়ে মাস্তান পুষছেন, ঠিকাদারির জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছেন, স্বার্থের জন্য রাজনৈতিক ডিগবাজি খাচ্ছেন, ক্ষমতার যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছেন, অন্যকে ল্যাং মারার ধান্ধা করছেন। ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য কলম ধরছেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে টেবিলের নিচ দিয়ে টাকার বান্ডিল আকর্ষণ করছেন, শিকার ঘায়েলের জন্য চুরি পিস্তল ইত্যাদি পোশাকের নিচে কিংবা ইউনিয়নবাজির আড়ালে নিজের আসল কাজকে পায়ে ঠেলে কালো আয়ের রাশ ধরেছেন। সাদা চোখে এ সমস্ত ঘাপটিমারাদের চিনা যায় না, কিন্তু আমাকে আপনি চিনতে পারেন দেখতে পারেন। শুধু দেখাই নয় অনুমানে আরো কিছু বুঝেও নিতে পারেন যেমন - অতিরিক্ত মাল বুঝাই বা অতিরিক্ত গতির জন্য যখন কোন ট্রাক থামিয়ে ড্রাইভারের কাগজ পরীক্ষা করি তখন ভেবে নেন আমি ঘুষ নিচ্ছি, লালবাতি পেরোনোর দায়ে যখন গাড়ি থামাই, বুঝে নেন যাত্রীর সঙ্গে অশোভন আচরণ করছি। রাস্তায় জটলাকারীদের সারানোর জন্য যখন লাঠিপেটা করি বুঝে নেন বিনা উস্কানীতে আমি গণ্ডগোল পাকাচ্ছি। আপনাদের আপনাদের নিয়ে যদি আমি আনুমানিক বুঝাবুঝি করি তার জন্য আপনারা নানা জায়গায় নালিশ, মামলা ইত্যাদি করে বসেন। আপনাদের কারো সম্পর্কে আমি যদি কোন অভিযোগ আনি তো, তা নিশ্চিত হয়েই আনতে হবে। নইলে বিপদ।
আপনারা আপপনাদের সন্তানদের আমাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আমার সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলেন। আমি আমার সন্তানদের সতর্ক করতে পারি না, আপনাদের মধ্যে যারা ছদ্মবেশী তাদের চিনি না বলে। আমাদের কাছে কোন দৈববাণী আসে না, আমি মানুষের ভূত ভবিষ্যৎ গুনতে জানিনা, আমার মাঝে আপনারা আমাকে ইংল্যান্ডের 'ববি' হতে বলেন কিন্তু নিজেরা ইংল্যান্ডবাসীর মতো গুণাবলী অর্জনে ব্রতী হন না। আপনি যখন উচ্চস্বরে আমার সঙ্গে কথা বলেন তখন সৎ সাহসের জন্য অন্যরা প্রশংসা করে, কিন্তু আমি যখন তেমন করে বলি আমি হয়ে যাই দাম্ভিক বেয়াদব। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রনে একটা কিছু করা দরকার এই বলে আপনি যখন বাহবাহ দিচ্ছেন পরক্ষণেই অবলীলায় সে অপরাধে আপনি নিজেই সামিল হয়ে যান। যারা আপনাকে তথাকথিত সৎসাহসের জন্য বাহবা দিলো তারা আপনাকে দেখে না কিন্তু আমি দেখি। আমি তখন আপত্তি জানালে শুধু আপনি নন আপনার অনুসারীরাও তেড়ে আসে। আপনি যখন অপরাধের শিকার হন তখন আমাকে আপনার নিজ পাজরের কাছে প্রত্যাশা করেন, আবার সুখ শান্তিতে থাকেন তখন আপনার আঙ্গিনাও যেন না মাড়াই সেই মুনাজাত করেন। আমার নজরদারীর জন্য যখন আপনার সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে আপনি ঘূনাক্ষরেও আমাকে ধন্যবাদ দেন না, কিন্তু আমার দৃষ্টি গলিয়ে যখন অপরাধী আপনাকে ঘায়েল করে আমাকে তখন শুলে চড়ান। পুলিশ যুগোপযোগী নয় বলে সেমিনারে গলা ফাটান, কলমের কালি ফুরান, আবার পুলিশ খাতে সরকারি বরাদ্দ একটু বেশি হলেই আঙুল তুলে আপত্তি জানান।
আমার সান্ত্বনা হয়ত এই আমি ছিলাম, আছি এবং থাকবো। আপনারা যতদিন থাকবেন আমিও ততদিন থাকবো। আমাকে মুছে ফেললে আপনার রয়ে যাওয়া শান্তিটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাকে নিয়েই বাঁচতে হবে আপনাদের। আপনাদের সম্পদ, আপনাদের দেহ, আপনাদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য এখনো আমি হাজির হই। এটিই আমার জীবনের পরম পাওয়া।
ইতি- আপনাদের সুরত আলী।
চল্লিশ রাত্তিরেই মিসেস সুরত আলী তদীয় মৃত স্বামীকে স্বপ্নে দেখলেন প্রথম। শেষ বিচারের মাঠে লক্ষলক্ষ মানব সন্তান পেরেশানের সাথে শেষভাগ্য নির্ধারণের অপেক্ষায়। সুরত আলীর মুখে উৎকণ্ঠা আরো বেশি। আলোর তৈরি ফেরেশতা তাকে সামনে ডাকলেন।
স্বর্গ কিংবা নরক নির্ধারিত হবে তার।
ফেরেশতাঃ - পৃথিবীতে থাকার সময় নিয়মিত ইবাদত কি করতে তুমি?
সুরত আলীঃ-না, আমি পারি নি। এমনকি সপ্তাহের পবিত্রতম দিনটিতে সবাই যখন ইবাদতে মশগুল আমি তখন রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছি, মানুষের নিরাপত্তার জন্য রাস্তায় টহল দিচ্ছি, সময়ের অভাবে পুলিশের পোশাক খুলে পাক পবিত্র হওয়ার জন্য অজু গোসল করতে পারিনি। এমনকি বছরে যে দুইবার বিশেষ জমায়েত তাতেও সামিল হতে পারিনি। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।
ফেরেশতাঃ মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহার কি করতে তুমি?
সুরতঃ না, আমি তাও পারিনি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে আমার প্রচুর কষ্ট হতো। দায়িত্ব পালনকালে সময়ের কোন সীমারেখা ছিল না। নিয়ম মাফিক খাওয়া যেতো না। এর মধ্যে মেজাজ সব সময় ঠিক রাখা যেতো না। সেই সময়গুলোতে ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি অনেকের সঙ্গে রুঢ় হয়েছি।
ফেরেশতাঃ তুমি তোমার সন্তানদের সুশিক্ষা দিয়েছো কি?
সুরতঃ না, পারি নি। আয় যা ছিল তা দিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থেকে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ পুরোটা যোগাতে পারি নি। প্রায় প্রতি বছর বদলীর জন্য কোথাও স্থিতিশীল হয়ে বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে দিতে পারি নি। পড়াশুনায় ওদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। সীমাহীন কাজের জন্য নিজের সন্তানদের দিকে নজর দিতেও পারি নি। নিজে নিজে কষ্ট করে দু'য়েকটা মানুষ হয়েছে, বাকিগুলো উচ্ছন্নে গেছে।
ফেরেশতাঃ তাহলে তুমি ভালো কাজটা কি করেছো?
সুরতঃ যে পয়সা আমার প্রাপ্য নয় বলে আমার বিবেক বলেছে সুযোগ পেয়েও আমি তা গ্রহন করিনি । জীবনে ভালো কাজ বলতে ওটুকুই।
সুনসান নীরবতা। পুলিশ কর্মকর্তা সুরত আলীর ভাগ্য নির্ধারণের পালা। কয়েক মুহুর্ত পর গায়েবী আওয়াজ হলো যে- সুরত আলী পৃথিবীতে তোমার নরক বাস শেষ হয়েছে। এবার তুমি স্বর্গে প্রবেশ করো।
মিসেস সুরত আলীর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি আচমকা উঠে বসে মৃত স্বামীকে স্মরণে আনলেন। আশ্চর্য তিনি আর আগের মত কষ্ট পেলেন না।
পরম শ্রদ্বেয় জনাব আনসার উদ্দিন খান পাঠান (Ansar Uddin Khan Pathan) স্যারের "গর্জনে বর্ষণে" বই থেকে সংগ্রহীত।
লেখক: এসপি (মৌলিক প্রশিক্ষণ), বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি, সারদা।
মরহুম সুরত আলী একজন ছোটখাটো পুলিশ অফিসার ছিলেন। হার্টের ব্যামোতে তিনি হঠাৎ পরলোক গমন করেন। পরলোক যাওয়ার আগে অবশ্য তাঁর চাকরি থেকে রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেই সুযোগে তিনি চশমার পুরু কাচের ভিতর দিয়ে পুলিশ নয় একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে নিজ সংসার, সমাজ আর দেশকে দেখে গেছেন ক'দিন। গিন্নির উচ্চস্বরে সাংসারিক অনটন সংক্রান্ত নিত্যদিনের তিক্ত বক্তৃতা, মাঝারী ও ছোট পুত্রের উচ্ছন্নে যাওয়া, তিন নম্বর কন্যার প্রেম করে অর্ধ বেকারের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া এবং তদউদ্ভুত ঘোলাটে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। রাস্তায় বিষাক্ত বাতাস সেবন, রাজনৈতিক ডামাডোল আর আইন-শৃখলার অবনতি সংক্রান্ত টেনশন ইত্যাদি সবমিলে তার দুর্বল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াকে দ্রুত নিস্তব্ধ করে দিল।
মরে যাওয়ার ৪০ দিন পর বিশেষ দোয়া উপলক্ষে মরহুমের সকল পুত্র কন্যা একত্রিত হলো। দোয়া আরজ গোজার শেষে রাত্রিবেলায় তার পুত্র-কন্যারা মনিমাণিক্যের সুরত আলীর জীবন ভর আঁকড়ে রাখা ফুল আঁকা মরচে ধরা ট্রাংকের ডালা ভাঙলো। মূল্যবান কিছু না পেয়ে শোকের মাত্রা আরো বাড়লো। পাওয়া গেলো রুমাল দিয়ে পেচানো একটা পুটলা তার মধ্যে একটা কিছু অদ্ভুত চিঠি, সুরত আলীর লেখা।
তার মধ্যে একটি এরকম-
"আশা করি আপনারা আমাকে চিনতে পেড়েছেন। দুষ্টের দমনকারী, শিষ্টের লালনকারী, অত্যাচারিতের ভরসা, আইনের রক্ষক, নিরাপত্তার প্রতীক কিংবা ঘোষখোর, চোরের বন্ধু, আইনের ভক্ষক, সরকারের পেটুয়া বাহিনী, জুলুমবাজ ইত্যাদি যেকোন গোত্রে আমাকে ফেলতে পারেন। যেটিতেই ফেলেন না কেন যুক্তির কোন অভাব হবে না। একই পোশাক, একই কাজ, একই সমতলে যুগ যুগ ধরে আছি। আমাকে চিনতে আপনাদের একটুও ক্লেশ হওয়ার কথা নয়। পক্ষান্তরে আপনাদের আমি ভাল করে চিনতে পারি না। আপনারা সকলেই উত্তম পোশাকে থাকেন, সুন্দর যুক্তিগ্রাহ কথা বলেন। গাড়ি, বাস, স্কুটার আর রিকসা দিয়ে প্রতিদিন নগরের রাস্তা ধরে পিপড়ের মত ছুটে যান। আমি চিনতে পারিনা আপনাদের মধ্যে কে রাষ্ট্রের কর ফাঁকি দিচ্ছেন, রাষ্ট্রের কোষাগারকে নিজের স্বপ্নে পাওয়া ধন বলে নয়-ছয় করছেন, পয়সা দিয়ে মাস্তান পুষছেন, ঠিকাদারির জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছেন, স্বার্থের জন্য রাজনৈতিক ডিগবাজি খাচ্ছেন, ক্ষমতার যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছেন, অন্যকে ল্যাং মারার ধান্ধা করছেন। ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য কলম ধরছেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে টেবিলের নিচ দিয়ে টাকার বান্ডিল আকর্ষণ করছেন, শিকার ঘায়েলের জন্য চুরি পিস্তল ইত্যাদি পোশাকের নিচে কিংবা ইউনিয়নবাজির আড়ালে নিজের আসল কাজকে পায়ে ঠেলে কালো আয়ের রাশ ধরেছেন। সাদা চোখে এ সমস্ত ঘাপটিমারাদের চিনা যায় না, কিন্তু আমাকে আপনি চিনতে পারেন দেখতে পারেন। শুধু দেখাই নয় অনুমানে আরো কিছু বুঝেও নিতে পারেন যেমন - অতিরিক্ত মাল বুঝাই বা অতিরিক্ত গতির জন্য যখন কোন ট্রাক থামিয়ে ড্রাইভারের কাগজ পরীক্ষা করি তখন ভেবে নেন আমি ঘুষ নিচ্ছি, লালবাতি পেরোনোর দায়ে যখন গাড়ি থামাই, বুঝে নেন যাত্রীর সঙ্গে অশোভন আচরণ করছি। রাস্তায় জটলাকারীদের সারানোর জন্য যখন লাঠিপেটা করি বুঝে নেন বিনা উস্কানীতে আমি গণ্ডগোল পাকাচ্ছি। আপনাদের আপনাদের নিয়ে যদি আমি আনুমানিক বুঝাবুঝি করি তার জন্য আপনারা নানা জায়গায় নালিশ, মামলা ইত্যাদি করে বসেন। আপনাদের কারো সম্পর্কে আমি যদি কোন অভিযোগ আনি তো, তা নিশ্চিত হয়েই আনতে হবে। নইলে বিপদ।
আপনারা আপপনাদের সন্তানদের আমাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আমার সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলেন। আমি আমার সন্তানদের সতর্ক করতে পারি না, আপনাদের মধ্যে যারা ছদ্মবেশী তাদের চিনি না বলে। আমাদের কাছে কোন দৈববাণী আসে না, আমি মানুষের ভূত ভবিষ্যৎ গুনতে জানিনা, আমার মাঝে আপনারা আমাকে ইংল্যান্ডের 'ববি' হতে বলেন কিন্তু নিজেরা ইংল্যান্ডবাসীর মতো গুণাবলী অর্জনে ব্রতী হন না। আপনি যখন উচ্চস্বরে আমার সঙ্গে কথা বলেন তখন সৎ সাহসের জন্য অন্যরা প্রশংসা করে, কিন্তু আমি যখন তেমন করে বলি আমি হয়ে যাই দাম্ভিক বেয়াদব। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ আর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রনে একটা কিছু করা দরকার এই বলে আপনি যখন বাহবাহ দিচ্ছেন পরক্ষণেই অবলীলায় সে অপরাধে আপনি নিজেই সামিল হয়ে যান। যারা আপনাকে তথাকথিত সৎসাহসের জন্য বাহবা দিলো তারা আপনাকে দেখে না কিন্তু আমি দেখি। আমি তখন আপত্তি জানালে শুধু আপনি নন আপনার অনুসারীরাও তেড়ে আসে। আপনি যখন অপরাধের শিকার হন তখন আমাকে আপনার নিজ পাজরের কাছে প্রত্যাশা করেন, আবার সুখ শান্তিতে থাকেন তখন আপনার আঙ্গিনাও যেন না মাড়াই সেই মুনাজাত করেন। আমার নজরদারীর জন্য যখন আপনার সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে আপনি ঘূনাক্ষরেও আমাকে ধন্যবাদ দেন না, কিন্তু আমার দৃষ্টি গলিয়ে যখন অপরাধী আপনাকে ঘায়েল করে আমাকে তখন শুলে চড়ান। পুলিশ যুগোপযোগী নয় বলে সেমিনারে গলা ফাটান, কলমের কালি ফুরান, আবার পুলিশ খাতে সরকারি বরাদ্দ একটু বেশি হলেই আঙুল তুলে আপত্তি জানান।
আমার সান্ত্বনা হয়ত এই আমি ছিলাম, আছি এবং থাকবো। আপনারা যতদিন থাকবেন আমিও ততদিন থাকবো। আমাকে মুছে ফেললে আপনার রয়ে যাওয়া শান্তিটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাকে নিয়েই বাঁচতে হবে আপনাদের। আপনাদের সম্পদ, আপনাদের দেহ, আপনাদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য এখনো আমি হাজির হই। এটিই আমার জীবনের পরম পাওয়া।
ইতি- আপনাদের সুরত আলী।
চল্লিশ রাত্তিরেই মিসেস সুরত আলী তদীয় মৃত স্বামীকে স্বপ্নে দেখলেন প্রথম। শেষ বিচারের মাঠে লক্ষলক্ষ মানব সন্তান পেরেশানের সাথে শেষভাগ্য নির্ধারণের অপেক্ষায়। সুরত আলীর মুখে উৎকণ্ঠা আরো বেশি। আলোর তৈরি ফেরেশতা তাকে সামনে ডাকলেন।
স্বর্গ কিংবা নরক নির্ধারিত হবে তার।
ফেরেশতাঃ - পৃথিবীতে থাকার সময় নিয়মিত ইবাদত কি করতে তুমি?
সুরত আলীঃ-না, আমি পারি নি। এমনকি সপ্তাহের পবিত্রতম দিনটিতে সবাই যখন ইবাদতে মশগুল আমি তখন রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছি, মানুষের নিরাপত্তার জন্য রাস্তায় টহল দিচ্ছি, সময়ের অভাবে পুলিশের পোশাক খুলে পাক পবিত্র হওয়ার জন্য অজু গোসল করতে পারিনি। এমনকি বছরে যে দুইবার বিশেষ জমায়েত তাতেও সামিল হতে পারিনি। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।
ফেরেশতাঃ মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহার কি করতে তুমি?
সুরতঃ না, আমি তাও পারিনি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে আমার প্রচুর কষ্ট হতো। দায়িত্ব পালনকালে সময়ের কোন সীমারেখা ছিল না। নিয়ম মাফিক খাওয়া যেতো না। এর মধ্যে মেজাজ সব সময় ঠিক রাখা যেতো না। সেই সময়গুলোতে ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি অনেকের সঙ্গে রুঢ় হয়েছি।
ফেরেশতাঃ তুমি তোমার সন্তানদের সুশিক্ষা দিয়েছো কি?
সুরতঃ না, পারি নি। আয় যা ছিল তা দিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থেকে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ পুরোটা যোগাতে পারি নি। প্রায় প্রতি বছর বদলীর জন্য কোথাও স্থিতিশীল হয়ে বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে দিতে পারি নি। পড়াশুনায় ওদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। সীমাহীন কাজের জন্য নিজের সন্তানদের দিকে নজর দিতেও পারি নি। নিজে নিজে কষ্ট করে দু'য়েকটা মানুষ হয়েছে, বাকিগুলো উচ্ছন্নে গেছে।
ফেরেশতাঃ তাহলে তুমি ভালো কাজটা কি করেছো?
সুরতঃ যে পয়সা আমার প্রাপ্য নয় বলে আমার বিবেক বলেছে সুযোগ পেয়েও আমি তা গ্রহন করিনি । জীবনে ভালো কাজ বলতে ওটুকুই।
সুনসান নীরবতা। পুলিশ কর্মকর্তা সুরত আলীর ভাগ্য নির্ধারণের পালা। কয়েক মুহুর্ত পর গায়েবী আওয়াজ হলো যে- সুরত আলী পৃথিবীতে তোমার নরক বাস শেষ হয়েছে। এবার তুমি স্বর্গে প্রবেশ করো।
মিসেস সুরত আলীর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি আচমকা উঠে বসে মৃত স্বামীকে স্মরণে আনলেন। আশ্চর্য তিনি আর আগের মত কষ্ট পেলেন না।
পরম শ্রদ্বেয় জনাব আনসার উদ্দিন খান পাঠান (Ansar Uddin Khan Pathan) স্যারের "গর্জনে বর্ষণে" বই থেকে সংগ্রহীত।
লেখক: এসপি (মৌলিক প্রশিক্ষণ), বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি, সারদা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন